মোঃ আজগার আলী, স্টাফ রিপোর্টার, সাতক্ষীরা:
১৯৮৮ সালের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের পর শ্যামনগরের নদীভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে স্বামী মুনতাজ আলীকে নিয়ে সাতক্ষীরা শহরের কামালনগরে আশ্রয় নিয়েছিলেন রিজিয়া বেগম। চার দশক পেরিয়ে গেছে, বয়স হয়েছে ৬৫, কিন্তু দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। আগের প্রাকৃতিক দুর্যোগের বদলে এখন নতুন সংকট— ময়লা-আবর্জনায় ঘেরা বিষাক্ত পরিবেশ।
“ঘরের সামনের বাগানেই ময়লা ফেলা হয়। নিষেধ করলে শোনে না কেউ। জায়গার মালিকই বলে ফেলতে, কিন্তু আমার দরজার সামনে কেন?”—প্রশ্ন রিজিয়ার।
ঘরহীন মানুষের ভিড়ে হাঁসফাঁস শহর:
জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জসহ উপকূলীয় এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে সাতক্ষীরা শহরে আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার পরিবার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরা শহরের মোট জনসংখ্যা ১ লাখ ৩৮ হাজার ৩৯৭ জনের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার মানুষই বাস্তুচ্যুত।
এসব মানুষ শহরের কামালনগর, বোসপাড়া, লিচুতলা, রাজারবাগানসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। নেই ডাস্টবিন, নেই সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। রাস্তাঘাট, পুকুর কিংবা বাড়ির গেটের সামনেই ফেলা হচ্ছে আবর্জনা।
দক্ষিণ কামালনগরের বাসিন্দা জাহিদা বেগম বললেন, “জায়গা নাই, ডাস্টবিন নাই, কোথায় ফেলবো? সবাই ফেলে, আমিও ফেলি। জানি রোগ হবে, কিন্তু করবো কী?”
ময়লা জমে শহরের ফুসফুস বন্ধ:
সাতক্ষীরা পৌরসভার কনজারভেন্সি ইন্সপেক্টর মোঃ ইদ্রিস আলী বলেন, “শহরে প্রায় ৫০-৫৫টি ডাস্টবিন আছে। নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। তবে যানবাহন সংকট আমাদের বড় সমস্যা। মাত্র দুটি গাড়ি দিয়ে ৯টি ওয়ার্ডে কাজ চালানো কঠিন।”
পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকলেও ডাস্টবিনের সংকট, সরু গলি, যানজট ও বাজেট সীমাবদ্ধতার কারণে পুরো শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যত ভেঙে পড়েছে।
শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাসে বিষ:
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ কুদরত-ই-খুদা বলেন, “বর্জ্য থেকে নির্গত অ্যামোনিয়া, সালফারসহ বিষাক্ত গ্যাস শিশুদের ফুসফুসে ঢুকছে। এতে ডায়রিয়া, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, লিভার ও ফুসফুসজনিত সমস্যা বেড়েছে।”
শহরে জলবায়ু সংকটের নতুন রূপ: ‘নগর দুর্যোগ’:
পরিবেশবিদ ও উন্নয়নকর্মীরা বলছেন, সাতক্ষীরা এখন একটি নগর দুর্যোগের মুখে। উপকূল থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে শহরে এসে বসতি গড়া মানুষদের তৈরি বর্জ্য সঠিকভাবে অপসারণ না হওয়ায় শহরের পরিবেশ ভয়াবহভাবে দূষিত হচ্ছে।
প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব-এর সভাপতি এড. মুনির উদ্দীন বলেন, “সাতক্ষীরা শহরের চারপাশে এখন প্রায় ৪৭টি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বস্তি রয়েছে। সেখানে না আছে পরিকল্পিত বসতি, না আছে স্যানিটেশন বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ফলে শুধু আশ্রয় পাওয়া নয়, প্রতিনিয়তই নতুন দুর্যোগে পড়ছে মানুষ।”
প্রশাসনের স্বীকারোক্তি: সীমাবদ্ধতা আছে-
সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রশাসক মাশরুবা ফেরদাউস জানান, “বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের বড় সীমাবদ্ধতা হলো বাজেট ও জায়গার সংকট। নতুন ল্যান্ডফিল বা ডাস্টবিন বসানোর চেষ্টা করলে স্থানীয় বাধা আসে। পুরনো অবকাঠামো ও দ্রুত নগরায়নের চাপে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া যাচ্ছে না।”
সমাধান কী?
পরিবেশবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাধানের জন্য জরুরি কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে:
১. শহরের বাইরে আধুনিক ল্যান্ডফিল স্থাপন।
২. প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিউনিটি ডাস্টবিন।
৩. পৌরসভার জনবল ও বাজেট বৃদ্ধি।
৪. বাড়ি ও স্কুলভিত্তিক বর্জ্য সচেতনতা।
৫. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বিত কর্মসূচি।
৬. স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ।
সবার জন্যই এই দায়:
এখনকার বর্জ্য আর শুধু দুর্গন্ধ নয়—এটি জলবায়ু সংকটের অংশ। শহরের প্রতিটি বাসিন্দা, প্রশাসন ও সরকার—সবারই দায়িত্ব আছে এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার। বাস্তুচ্যুত মানুষেরা আশ্রয় চেয়েছে, কিন্তু এখন তারা আশ্রয়েই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে।
পরিবেশ রক্ষা, নাগরিক স্বাস্থ্য রক্ষা ও টেকসই শহর গড়ার জন্য এখনই দরকার সমন্বিত ও কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।