মোঃ আজগার আলী, স্টাফ রিপোর্টার, সাতক্ষীরাঃ
সাতক্ষীরা জেলায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলছে বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) অনুমোদনবিহীন ড্রিংকিং ওয়াটার উৎপাদনকারী কারখানা। এসব কারখানার বেশিরভাগেরই নেই স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্যানিটারি লাইসেন্স কিংবা কোনো প্রকার মান নিয়ন্ত্রণের সনদ। ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ অস্বাস্থ্যকর পানি পান করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন।
গোপনে গজিয়ে উঠছে কারখানাঃ
সরেজমিনে দেখা গেছে, শহর ও শহরতলির বিভিন্ন অলিগলিতে গড়ে উঠেছে এসব পানি শোধন ও বোতলজাতকরণ প্রতিষ্ঠান। কিছু কারখানা নামমাত্র লেবেল লাগিয়ে বোতলে ‘বিশুদ্ধ পানি’ বলে বাজারজাত করছে, কিন্তু বাস্তবে তাদের নেই আধুনিক যন্ত্রপাতি, ব্যাকটেরিয়া টেস্টিং ল্যাব বা প্রশিক্ষিত জনবল।
জনমনে উদ্বেগঃ
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, “আমরা বিশ্বাস করে জারের পানি খাই, কিন্তু এখন শুনছি অনেক প্রতিষ্ঠান সরকারের অনুমোদন ছাড়াই চলছে। এতে আমরা আতঙ্কিত।”
প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ও অভিযানঃ
স্বাস্থ্য বিভাগ ও বিএসটিআই সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরার অধিকাংশ পানির কারখানাই লাইসেন্সবিহীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী, ড্রিংকিং ওয়াটার উৎপাদনের আগে বিএসটিআই অনুমোদন, পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ও স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি বাধ্যতামূলক। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হলেও, তা কার্যকর প্রতিরোধে পরিণত হয়নি। যেমন ৮ মে চিশতিয়া ও সৌদিয়া ড্রিংকিং ওয়াটারকে এবং ৪ জুন আহিল ড্রিংকিং ওয়াটারকে ২৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতঃ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “অস্বাস্থ্যকর পানি পান করলে টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, কিডনি রোগ ও ডায়রিয়ার মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ে। শিশু ও বয়স্কদের জন্য এসব ঝুঁকি আরও ভয়াবহ।”
নিরাপদ পানির নামে প্রতারণাঃ
এতসব নিয়মের তোয়াক্কা না করেই অনেক কারখানা ব্যবহার করছে বিএসটিআই-এর লোগো, বিভিন্ন চটকদার লেবেল ও ভুয়া তথ্যসমৃদ্ধ বিজ্ঞাপন। এতে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ জনগণ।
লাইসেন্সের শর্তাবলীঃ
বিএসটিআই জানায়, সিএম লাইসেন্স পেতে হলে পণ্যের গায়ে অবশ্যই উল্লেখ থাকতে হবে—প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা, উৎপাদন ও মেয়াদ শেষের তারিখ, ওজন, মিনারেল কম্পোজিশন, ব্যাচ নম্বর, মূল্যসহ অন্যান্য তথ্য। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই ল্যাব, প্রশিক্ষিত কেমিস্ট, উৎপাদন যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকতে হয়।
বাস্তব চিত্র: অধিকাংশই মানছে না নিয়মঃ
সাতক্ষীরার অধিকাংশ পানি কারখানাই এসব শর্ত মানছে না। প্রশাসনের অভিযানে তাদের সাময়িক জরিমানা করা হলেও, তারা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে।
অনুমোদনবিহীন কারখানার তালিকাঃ (বিআইএসটিআই লাইসেন্স বিহীন):
আহিল, সুরমা, চিশতিয়া, সৌদিয়া, আল মক্কা, আরাফাত, আল কাওছার, উষা, গিতাঞ্জলি, শাপলা, অর্নিবান, তৃপ্তি, একোয়া, আল্লাহর দান, রসমো, মিষ্টি, বর্ষা, এ-ফ্রেশ, শীতল, মার্জিয়া, বৃষ্টি, জমজম, নিউ সাতক্ষীরা, পিপাসা, মাওয়া, তাজা, জান পিউর, এম.কে মিনারেল।
অনুমোদিত কারখানাঃ
রিমঝিম, হক, তাহা, শর্মি, ঋশিল্পী, উত্তরণ ড্রিংকিং ওয়াটার।
লাইসেন্স প্রক্রিয়াধীন কারখানাঃ
মাহিম, তৌফিক, সাফা মক্কা, ঝর্ণা ড্রিংকিং ওয়াটার।
সাধারণ মানুষের আহ্বানঃ
সাধারণ মানুষ ও সচেতন মহলের দাবি, এসব অনিয়ম বন্ধে নিয়মিত মনিটরিং, অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সর্বোপরি, নিরাপদ পানির অধিকার নিশ্চিত করতে প্রশাসনের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে। বোতল কেনার আগে বিএসটিআই সনদ, মেয়াদ এবং উপাদান যাচাই করা এখন সময়ের দাবি।